উড়োজাহাজ থেকে লাখ কোটি মাছি ফেলার পরিকল্পনাটি শুনতে ভয়াবহ লাগলেও এই পদ্ধতি প্রাণঘাতী পরজীবীর আক্রমণ থেকে গবাদিপশুকে সুরক্ষিত রাখবে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিশেষজ্ঞরা। ২০২৩ সালের শুরু থেকে মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুবর্ম’ নামের এক ধরনের লার্ভা, যা উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণীর শরীরে ক্ষত খুঁজে বাসা বাঁধে এবং ধীরে ধীরে জীবন্ত কোষ খেয়ে ফেলে। প্যানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা ও এল সালভাদরে এদের প্রাদুর্ভাব ধরা পড়েছে। এই অঞ্চলের অনেক দেশে দুই দশক ধরে এ ধরনের সংক্রমণ দেখা যায়নি।
২০২৪ সালের শেষদিকে মাছিগুলো দক্ষিণ মেক্সিকোতে পৌঁছায়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খাত নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর গবাদিপশু, ঘোড়া ও বাইসন বিক্রির কাজে ব্যবহৃত বন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। খবর সিএনএনের।
১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে একই ধরনের প্রাদুর্ভাব যুক্তরাষ্ট্র দমন করেছিল একটি অভিনব পদ্ধতিতে। পুরুষ স্ক্রুবর্ম মাছিদের প্রজননকালীন সময় গামা রশ্মি দিয়ে বন্ধ্যাত্ব ঘটিয়ে আকাশ থেকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। স্ত্রী মাছিগুলো একবারই মিলিত হয় এবং বন্ধ্যা পুরুষের সঙ্গে মিলনের ফলে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না। এভাবে ধীরে ধীরে পুরো প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যায়।
আরও পড়ুন : যুক্তরাষ্ট্রে শত বছরের ইতিহাসে আকস্মিক বন্যায় নিহত-নিখোঁজ ২৮১, দায় কার
এই পদ্ধতিই আবার প্রয়োগ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, তবে এবার বিপুল পরিমাণ মাছি লাগবে। বর্তমানে প্যানামায় একটি মাত্র উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, যা যথেষ্ট নয়। ২০২৫ সালের জুনে ৮০ মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের চিঠিতে আরও মাছির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়।
চাহিদা পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তর ১৮ জুন ঘোষণা দেয়, টেক্সাস-মেক্সিকো সীমান্তবর্তী এক শহরে স্থাপন করা হবে নতুন মাছি উৎপাদন কেন্দ্র। এটি হবে ‘ফ্লাই ফ্যাক্টরি’, যার মাধ্যমে কোটি কোটি বন্ধ্যা মাছি তৈরি করে আকাশপথে ছড়ানো হবে। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ কোটি ডলার।
বর্তমানে সপ্তাহে প্রায় ১০ কোটি মাছি উৎপাদন ও বিতরণ করা হচ্ছে প্যানামা-মেক্সিকো অঞ্চলে। নতুন কেন্দ্রটি সম্ভবত টেক্সাসের হিডালগো কাউন্টির মুর এয়ার বেসে নির্মিত হবে।
নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুবর্ম হচ্ছে এক ধরনের চকচকে নীল-সবুজ মাছির লার্ভা। এটি পশ্চিম গোলার্ধে পাওয়া একমাত্র ব্লো ফ্লাই (মরা প্রাণীর দেহে বাস করা মাছি) যা জীবন্ত প্রাণীর মাংস খায়।
টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. ফিলিপ কাউফম্যান বলেন, ‘স্ত্রী মাছি কোনো প্রাণীর ক্ষতের উপর ২০০-৩০০ ডিম পাড়ে। ১২-২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেগুলো টিস্যু খেতে শুরু করে।' কয়েকদিন খাওয়ার পর তারা মাটিতে পড়ে গিয়ে পিউপায় পরিণত হয় এবং পরে আবার মাছি হয়ে জন্ম নেয়।
২০২৩ সাল থেকে ৩৫ হাজারের বেশি সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৮৩ শতাংশই গরু। গবাদিপশু আক্রান্ত হলে চিকিৎসার অংশ হিসেবে ক্ষত পরিষ্কার, অ্যান্টিসেপটিক প্রয়োগ ও ক্ষত ঢেকে রাখা হয়। তবে চিকিৎসা না করলে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই প্রাণীটির মৃত্যু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবাদিপশু খামারের মালিক স্টিফেন ডিয়েবেল বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের পশুগুলো পরীক্ষা করতে হয়। একবার সংক্রমণ শুরু হলে এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিপর্যয়কর হবে।‘
সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য কোনো টিকা বা কার্যকর প্রতিরোধক নেই। ফলে গরমের সময় খামারিরা গরুদের কান ট্যাগ দেয়া, ব্র্যান্ডিং ইত্যাদি এড়িয়ে চলে যাতে নতুন ক্ষত না তৈরি হয়।
বন্ধ্যা মাছির লার্ভা পিউপা হয়ে উঠলে তাতে গামা রশ্মি প্রয়োগ করা হয়, যা পুরুষ মাছির ডিএনএ ধ্বংস করে ফেলে। ফলাফল-মাছিগুলো বন্ধ্যা হয়ে যায় এবং ডিম নিষ্ফল হয়। স্ত্রী মাছি একবারই মিলিত হয়, ফলে একবার এই প্রক্রিয়ায় পড়ে গেলে গোটা প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যায়।
এসব মাছি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পাত্রে ভরে বিমানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকায় ফেলা হয়। তবে জনবহুল শহরে নয়-সাধারণত এটি হয় গ্রামীণ ও পশুপালন নির্ভর অঞ্চলে।
পুরো পরিকল্পনার খরচ হতে পারে ৩০ কোটি ডলার। তবে পশু খাতে এর প্রভাব প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের সমান হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি ‘বোঝাপড়ার মতো বিনিয়োগ’ বলেই মনে করছেন তারা।’
দেশের ভেতরে এমন একটি কারখানা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে মাছির বিতরণ আরও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে,’ বলেন ডিয়েবেল।
ইতিমধ্যে মার্কিন কৃষি দপ্তর ঘোষণা দিয়েছে, মেক্সিকোতে একটি পুরোনো মাছি কারখানাকে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ আধুনিকায়ন করা হবে, যার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে আরও ২.১ কোটি ডলার।
এদিকে সীমান্তে কিছু পশু বাণিজ্য বন্দর পুনরায় চালু করার পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে, কারণ মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রে স্ক্রুবর্ম বিতরণ কার্যক্রম ইতিমধ্যে ভালো অগ্রগতি অর্জন করেছে, জানিয়েছে কৃষি দপ্তর।