শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলিউডে সাতের দশকের সমসাময়িক নায়কদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সুদর্শনতম। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। আদর্শ সুপুরুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। চোখের সেক্সি চাহনি থেকে প্রশস্ত মুখের দুর্নিবার আকর্ষণে তিনি জি
ঋতুপর্ণর প্রথম প্রেম ছিলেন বিনোদ খান্না! পড়ার বইয়ের ফাঁকে থাকত সুঠাম শরীরের ছবি
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বলিউডে সাতের দশকের সমসাময়িক নায়কদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সুদর্শনতম। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। আদর্শ সুপুরুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। চোখের সেক্সি চাহনি থেকে প্রশস্ত মুখের দুর্নিবার আকর্ষণে তিনি জিতে নেন আসমুদ্রহিমাচলের ভালবাসা। তিনি বিনোদ খান্না (Vinod Khanna)।
তাঁর আগের জমানায় ধর্মেন্দ্র ছিলেন বলিউডের হি-ম্যান। যেন তিনি টারজান। ধর্মেন্দ্রর কেরিয়ারের শুরুর দিকে দুর্দান্ত রোম্যান্টিক ইমেজ ছিল। ধর্মেন্দ্র অভিনীত সাদা-কালো ছবি 'অনুপমা', 'বাহারে ফির ভি আয়েগি' ছবিগুলো তারই উদাহরণ। সেই ধর্মেন্দ্রকে বলিউড একেবারেই হিম্যান বানিয়ে দেয় সাতের দশকে। তাঁর রোম্যান্টিক ব্যাপারটাই চলে গেল।
রাজেশ খান্না অবশ্য তখন সুপারস্টার, কিন্তু যৌন আবেদনে (Sex Appeal) তিনি পিছিয়ে। শশী কাপুর বড্ড বেশি অভিজাত। অন্যদিকে অমিতাভ একেবারেই অ্যাংরি ম্যান। আর সঞ্জীব কুমার নিজ গরিমায় গম্ভীর। এই সবার মধ্যে সেক্স অ্যাপিলে এগিয়েছিলেন একমাত্র সুদর্শন বিনোদ খান্না। ধর্মেন্দ্রর পর বিনোদের পুরুষালি চেহারাই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ধর্মেন্দ্রর যা ছিল না, বিনোদের তার সবই ছিল। যৌনতার মোহরস যেন চুঁইয়ে পরত তাঁর সুঠাম শরীরের পোশাকহীন ছবিগুলি থেকে।
বিনোদের সব থেকে বড় প্লাস পয়েন্ট ছিল, তাঁর ঈষৎ গভীর থুতনি, যা তাঁর আবেদন দ্বিগুন করত। তখনকার নায়কদের জিমচর্চিত ছবি ভাইরাল হওয়ার যুগ ছিল না। কিন্তু বলিষ্ঠ শরীরের সঙ্গে সেক্সি চোখে মাত করতেন বিনোদ খান্না। ডাকাতের চরিত্রে বিনোদের পৌরুষ নায়কোচিত। তবে সবথেকে বেশি তিনি নজর কাড়তেন পুলিশ অফিসারের চরিত্রে।
শুধু তাই নয়, একের পর এক শয্যাদৃশ্যে তিনি এমন কেরামতি করতেন, যা সবার ভয়ের ব্যাপার ছিল। একবার বিনোদের সঙ্গে চুম্বন দৃশ্য করতে গিয়ে ভয় পান ডিম্পল কাপাডিয়ার মতো সাহসী অভিনেত্রীও! যে 'ববি' ছবিতে ঝড় তোলেন, সেই ডিম্পলকেই নাকি বিনোদ চুমু খাওয়ার শট দেওয়ার সময়ে রীতিমতো কামড়ে ফেলেছিলেন। ডিম্পল ধমকের সুরে বিনোদকে থামান। মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গেও বিনোদের শয্যাদৃশ্য আইকনিক। বয়সে বড় বিনোদের কাছে জড়তা কাটাতে বেগ পেতে হয় মাধুরীকেও। তবে তাঁদের রতিদৃশ্য সুপারহিট 'আজ ফির তুমপে প্যায়ার আয়া হ্যায়' গানে।
বিনোদ আদতে পেশোয়ারের লোক। দেশভাগের সময় পেশোয়ার থেকে ভারতে চলে আসে তাঁর গোটা পরিবার। মুম্বইয়েই পড়াশোনা, কিন্তু ১৯৫৭ সালে দিল্লি চলে যান। বাকি পড়াশোনা সেখানেই। দিল্লিতে কলেজে পড়ার সময়ে থিয়েটার করতেন। হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার। তাই শরীরে ছিল খেলোয়াড়দের ছোঁয়া। সেই নিয়েই হয়ে গেলেন বলিউডের নায়ক।
থিয়েটারে বিনোদের অভিনয় দেখে সুনীল দত্ত তাঁকে ফিল্মে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে ‘মন কা মীত’ ছবিতে সুযোগ পান। প্রথম ছবিতে ছিলেন খলনায়কের চরিত্রে। এর পর একে একে ‘আন মিলো সজনা’, ‘পূরব অউর পশ্চিম’, ‘মেরা গাঁও, মেরা দেশ’, ‘সচ্চা ঝুটা’, ‘মস্তানা’,'অমর আকবর অ্যান্টনি', 'চাঁদনি'র মতো একের পর এক ছবি হাতে পান।
কিন্তু সব থেকেও একাকীত্বে ভুগতেন বিনোদ। স্ত্রী গীতাঞ্জলির সঙ্গে বিচ্ছেদ। মায়ের মৃত্যুর পর ভেঙে পড়েন। সন্ন্যাস নিয়ে আমেরিকায় ওশোর আশ্রমে চলে যান। দীর্ঘ সময় সন্ন্যাসী হয়েছিলেন এমন এক সুপারস্টার নায়ক, যা তখন ছিল চর্চার বিষয়। আটের দশকের শেষে আবার ফিল্মজগতে ফেরেন বিনোদ। চেহারায় মেদ এলেও তাঁর আবেদন যেন আরও বেড়েছিল মধ্যবয়সে। পরিণত পৌরুষ।
বিনোদ খান্নার ফ্যান কে না ছিলেন। বিখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের টিনএজ বয়সের ক্রাশ ছিলেন একমাত্র বিনোদ খান্না (Rituparno Ghosh Fantacized Vinod Khanna)। বিনোদ খান্না জড়িয়ে থাকতেন যেন ঋতুপর্ণের শয়নে স্বপ্ননে জাগরণে। পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার বোধে ঋতুপর্ণকে হাতেখড়ি করান বিনোদ খান্নাই। ঋতুপর্ণর প্রথম প্রেমিক বলা যায় বিনোদ খান্নাকেই। প্রথম ফ্যান্টাসি বলা ভাল। এ কথা অকপটে বলেছেন ঋতুপর্ণ নিজেই। ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবনে যতজন প্রেমিক এসছে, ঋতু সবার মধ্যেই বিনোদের চোখ, ঠোঁট, বুক খুঁজেছেন। সিনেমাহলেও ঋতুপর্ণ বহুবার গেছেন বিনোদ খান্নার টানে। ঋতুর বইয়ের পাতার ফাঁকে থাকত বিনোদ খান্নার খালিগায়ের ছবি।
অনেকেই শুনলে হাসবেন বা রসিকতা করবেন। ছেলের আবার পুরুষ প্রেমিক। ঋতুপর্ণ যখন টিনএজার তখন সমপ্রেম নিয়ে কলকাতা-সহ ভারতবর্ষে তেমন কোনও চর্চাই ছিল না। পরে বাংলা সিনেমায় ঋতুপর্ণ ঘোষই প্রথম তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে সমপ্রেমকে মূলস্রোতে আনলেন। পরে তো ছবিও করেছেন ঋতু এ বিষয়ে। বিনোদ খান্নাকে নিয়ে ঋতুপর্ণর ছবি করার ইচ্ছে থাকলেও, বাস্তব হয়নি।
ঋতুপর্ণ আজীবন মুক্তি পাননি বিনোদ খান্নার দুর্নিবার আকর্ষণ থেকে। ঋতু ছিলেন সাহসী। তাই তাঁর সেক্সুয়াল প্রেফারেন্সের কথা তিনি বলতে পেরেছিলেন। অথচ কত ছেলেরই তো এমন স্বপ্নের হিরো বা প্রেমিক থাকেই। কিন্তু সেসব গল্প ঘরবন্দি রয়ে যায় টিটকিরি, লজ্জা আর শাসনের আড়ালে।
বিনোদ খান্নার আগেই ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রয়াত হন ২০১৩ সালে। ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল মারা যান বিনোদও। ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হন তিনি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জানা যায়, ছ’বছর ধরে অসুস্থতা লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই ভাঙা শীর্ণ চেহারার বিনোদকে দেখে যৌবনদীপ্ত বিনোদের সুপুরুষ চেহারা মেলানো মুশকিল। জরা-ব্যাধি-দুঃখ তো থাকবেই। দেহ ছাই হবে। তবু রয়ে যাবে প্রেম।
আজ বিনোদ খান্না আর ঋতুপর্ণ ঘোষ দু'জনেই প্রয়াত। ঋতুর অপ্রকাশিত প্রেমও মনে রাখার লোক থাকবে না। কিন্তু বাতাসে ছড়িয়ে থাকবে এই অনুচ্চারিত ফ্যান্টাসি প্রেমের নির্বাক কাহিনি।